রাশিয়ার সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেবেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পেশাগত যোগ্যতা, দক্ষতা এতটাই আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে যে, রাশিয়ার দিক থেকে বাংলাদেশকে এ প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া ফেডারেশন সফরকালে এ ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, শ্রীলঙ্কা, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশের সেনা কর্মকর্তাদের বাংলাদেশের সেনা অফিসাররা মিরপুর ডিফেন্স সার্ভিস ও স্টাফ কলেজে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সামরিক এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বিদেশে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছে । টেররিজম, কাউন্টার টেররিজম, ইনসারজেন্সি, কাউন্টার ইনসারজেন্সি, কমান্ডজনিত বিষয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের প্রশিক্ষণ বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১২ হাজারের বেশি অফিসার, জওয়ান কর্মরত রয়েছেন। তাদের সাহসী, সনিষ্ঠ ভূমিকা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোসহ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। বাংলাদেশ থেকে আরও বেশিসংখ্যক সেনা অফিসার, সদস্য শান্তিরক্ষী বাহিনীতে নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে কথা বলেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগামী মার্চে রাশিয়া সফরের সূচি চূড়ান্ত করা হচ্ছে। সফরকালে রাশিয়া ফেডারেশনের সঙ্গে বাংলাদেশের ১৯টি চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ও প্রটোকল স্বাক্ষর হবে। এগুলো হচ্ছে- কৃষি, শিল্প, বেসামরিক বিমান চলাচল, বাণিজ্য, পররাষ্ট্র, জ্বালানি, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, টেলিকমিউনিকেশন, জাহাজ চলাচল, যুব ও ক্রীড়া, বস্ত্র ও পাট, খাদ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, বিজ্ঞান এবং তথ্য-প্রযুক্তি যোগাযোগ, শিক্ষা সংক্রান্ত। দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়াও এসব চুক্তি ও প্রটোকলের বেশির ভাগই বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধকালে প্রয়াত সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ ও কসিগিন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাদের সমাধিতে প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করবেন।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে সরাসরি বিমান চলাচল শুরু হবে। এ ব্যাপারে দু’দেশের মধ্যে এয়ার সার্ভিস এগ্রিমেন্ট হবে। খসড়া চুক্তি অনুযায়ী সপ্তাহে একটি ফ্লাইট ঢাকা-মস্কো রুটে যাতায়াত করবে। চুক্তির খুঁটিনাটি এখন চূড়ান্ত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। রাশিয়ার সহযোগিতায়ই এ স্যাটেলাইট পাঠানো হবে। রাশিয়া বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সে দেশে প্রশিক্ষণ দেবে। শিপিং করপোরেশনের জন্য দু’টি জাহাজ কেনার ব্যাপারেও চুক্তি হবে। এ জন্য সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেবে রাশিয়া। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ও রাশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে।
সূত্র আরও জানায়, রাশিয়ায় বেশ কিছু সংখ্যক বস্ত্র ও সূতাকল রুগ্‌ণ অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। রাশিয়া ও বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা যৌথভাবে এসব কল কারখানার যন্ত্রপাতি বাংলাদেশে এনে চালু করবে। এতে বাংলাদেশের শ্রমিকদের কাজের সংস্থান হবে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানিও করতে পারবে। বস্ত্র ও পাট খাতে বাংলাদেশের জনশক্তিকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতেও তারা আগ্রহী। রাশিয়া ঢাকায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক পাট গবেষণা সংস্থার সদস্য অথবা অবজারভার হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা নেবে।
এছাড়া, বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে বছরে দুই লাখ টন গম কিনতে চাইছে। আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুযায়ীই এ খাদ্যশস্য কেনা হবে। ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশ বছরে এক লাখ টন গম কেনার চুক্তি করেছে। বাংলাদেশে গমের যথেষ্ট উৎপাদন-স্বল্পতা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য সরবরাহ স্বল্পতার কারণে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে। রাশিয়া থেকে প্রতি বছর দু’লাখ টন গম আমদানির নিশ্চয়তা থাকলে অভ্যন্তরীণ বাজারে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সহজতর হবে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গম উৎপাদনকারী দেশ রাশিয়া। গত বছর রাশিয়ায় ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরূপ প্রভাবে বিশ্ববাজারে গমের দাম বেড়ে যায়। রাশিয়ার সঙ্গে এ ব্যাপারে ৫ বছর মেয়াদি চুক্তি হবে।
বাংলাদেশ চায় রাশিয়ার শিল্পপতিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করুক। রাশিয়াও বাংলাদেশের শিল্পপতি, বিনিয়োগকারীদের সে দেশে বিনিয়োগে উৎসাহী করতে চায়। এ লক্ষ্যে দু’দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হবে। এ সংক্রান্ত খসড়া চুক্তি গত মার্চে রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে। সরকার রাশিয়া থেকে বছরে দু’লাখ টন ইউরিয়া সংগ্রহ করতে চায়। শিপ নির্মাণে রাশিয়ার বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে। দু’দেশের মধ্যে যৌথ বিজনেস কাউন্সিল গঠন করার প্রক্রিয়া চলছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে সামুদ্রিক মাছ নিতে আগ্রহী রাশিয়া। দ্বৈতকর পরিহারের ব্যাপারে দু’দেশের মধ্য সমঝোতা হবে। রাশিয়ার কাছে এ সংক্রান্ত একটি তালিকা পাঠানো হয়েছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়া ছিল বাঙালির অকৃত্রিম বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধকালীন অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল তাদের কাছে রয়েছে। রাশিয়া থেকে সেসব ডকুমেন্ট সংগ্রহ করা হবে। তেল, গ্যাস অনুসন্ধানে সমঝোতা স্মারক ও সংস্কৃতিক সহযোগিতা প্রটোকল স্বাক্ষর হবে। বাংলাদেশ থেকে রাশিয়া কৃষি শ্রমিকও নেবে। প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেবে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ থেকে উন্নত মানের আলু রপ্তানির ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে। বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে মেডিকেল, প্রকৌশল, সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক বিনিময় হবে। এক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অন্য দেশে স্বীকৃতি দেয়া হবে। এ সংক্রান্ত প্রটোকল স্বাক্ষরিত হবে।
এর মধ্যে নিউক্লিয়ার ও রেডিয়েশন সেফটি কনট্রোল সম্পর্কে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ। এ চুক্তির আওতায় রূপপুর পারমাণবিক শক্তি প্রকল্পে কারিগরি ও আর্থিক সহযোগিতা সংক্রান্ত পৃথক চুক্তি স্বাক্ষর হবে।

No comments

Powered by Blogger.